আত্মহত্যার আগে - মোঃ মিসাদ আলী || ছোটগল্প



ছোটগল্প: আত্মহত্যার আগে 

ফেসবুক লাইভে এসে একসঙ্গে তিনজনকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা, আর সেই ভিডিয়ো ভাইরাল। এমনটা আগে কখনও হয়েছে বলে মনে হয় না।

আজ বিকাল সোয়া চারটার নাগাদ হত্যা করা হয় শহরের নামি-দামী বিজনেস টাইকুন মিস্টার জামাল হোসেন, শরীফ আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদের তিন ছেলে শিহাব, শাহীন এবং শাহরিয়ারকে। আর সম্পুর্ণ হত্যাকাণ্ড ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে দেখে বিশ্ববাসী। ভিডিয়োর শেষে দেখা যায় হত্যাকারী নিজে আত্মহত্যা করে। ভিডিয়োটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। এবং জানা যায় হত্যাকারী শামীম, যে এক রিকশা চালকের ছেলে।

পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে দেখে অনেক মানুষের ভীড় জমে গেছে। সাথে মিডিয়ার লোকজন তো আছেই।

গোয়েন্দা বিভাগের সিনিয়র ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান এগিয়ে যান মৃতদেহের দিকে। গোয়েন্দা টিম চারিদিক পর্যবেক্ষণ করছে। লাশগুলোর কাছে এসে সেগুলো দেখলে পেট গুঁড়িয়ে আসে মাহফুজুর রহমানের। 

-স্যার, খুবই বিভৎসভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদেরকে। সবার চোখ উপড়ে হাতের মুঠোয় রাখা হয়েছে, দাতগুলোও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বুকের পাঁজর ভেঙ্গে ছিঁড়ে বের করা হয়েছে হৃদপিণ্ড।' এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শ্বাস নিয়ে আবার বলতে থাকে গোয়েন্দা বিভাগের জুনিয়র অফিসার মিস্টার সিরাজ' মনে হচ্ছে খুনি তীব্র ঘৃণা মনের মধ্যে পুষে রেখেছিল অনেকদিন থেকেই। আজ সুযোগ পেয়ে সব সুদে আসলে উসুল করে নিয়েছে।

-কিন্তু একটা বিষয় আমার মাথায় কিছুতেই আসে না, এত বড়ো বিজনেসম্যানের ছেলেদের সাথে এক রিকশা চালকের ছেলের শত্রুতা হয় কীভাবে!' সিরাজের দিকে তাকিয়ে বললেন মাহফুজুর রহমান, তার চোখ-মুখে গভীর চিন্তার ছাপ।

-স্যার, বড়ো লোকের নস্ট ছেলেদের ক্ষেত্রে এমনটা অসম্ভব কিছু না।

-তা ঠিক বলেছো সিরাজ। এলাকায় যা দাপট ছিল তাদের, সবধরনের খারাপ কাজের সাথে জড়িত ছিল তারা। শুধুমাত্র সঠিক প্রমাণের অভাবে তাদেরকে কিছু করতে পারিনি।' এতটুকু বলে মিস্টার সিরাজের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন' আর কিছু কি পাওয়া গেল আশেপাশে?

-না স্যার, তবে অনুসন্ধান চলছে।' চটপট করে জবাব দিলো সিরাজ

-ওকে, কিছু পাওয়া গেলে অফিসে নিয়ে এসো, আমার কিছু কাজ আছে। এমনিতেই এই কেসে অনুসন্ধানের তেমন কিছু নেই। হত্যাকারী হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেছে, এখন শুধু হত্যার কারণটা খুঁজে বের করতে হবে। আর খুঁজে বের করতে না পারলেও সমস্যা নেই, এই কেস ক্লোজড করে দিবো।' এইটুকু বলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করলেন মাহফুজুর রহমান

সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ল। লাশগুলো ফরেনসিক ল্যাবে দিয়ে অফিসে গেল সিরাজ। ফরেনসিক টিমও তেমন কিছু পেল না, তাই লাশগুলো তাদের বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো। কেসটার পেছনে তেমন সময় ব্যায় করতে হলো না দেখে কিছুটা খুশি মাহফুজুর রহমান।

প্রথম ঘটনার ঠিক সাত দিনের মাথায় একই মাধ্যমে আরেকটা খুন হলো, এবং খুনি আত্মহত্যা করলো। এবার মাহফুজুর রহমান কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন, ভাবতে শুরু করলেন কেসের ব্যাপারে।

হটাৎ তার মাথায় এলো, কেউ যদি লাইভে এসে হত্যা করার পর আত্মহত্যা করে তবে লাইভ অফ করছিল কে? এই একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল তার মাথায়।

বেরিয়ে পড়লেন ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে, মাত্র একটি ক্লু তার প্রয়োজন কেস সলভ করতে। আর তার বিশ্বাস, খুনি কোনো না কোনো ভুল করেই থাকবে, যেটা থেকে খুনির কাছ অব্দি পৌঁছানো যাবে অনায়াসেই।

ঘটনাস্থলে এবারও তেমন কিছু পাওয়া গেল না। তাই তিনি আত্মহত্যাকারীদের ব্যাপারে খোঁজ নেয়া শুরু করলেন। দুজনের মাঝে সম্পর্কযুক্ত ছোটো বিষয়গুলোও বাদ দিতে চায়ছেন না তিনি।

তারা দুজনেই বেশ কিছদিন থেকে ডিপ্রেশনে ভুগছিল, মাঝে মাঝেই আত্মহত্যা করার কথা বলতো তাদের ফ্রেন্ডদের। আরও কিছু অনুসন্ধানের পর কেসের একটা সমাধানের পথ পেলেন। কিছু ধারণা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন কারো উদ্দেশ্যে।

গ্রীষ্মের দুপুর, 

চারিদিকে প্রচন্ড গরমে যখন সবাই অতিষ্ট, এমন একটা সময় রাস্তার পাশে ফুটপাতে একটা লোক চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বিষয়টা অনেক অস্বাভাবিক লাগে তুহিনের কাছে, তাই চাদরটা সরিয়ে লোকটিকে জাগাতে যায়। কিন্তু চাদরটা সরাতেই গা শিউরে ওঠে তার। মাথাহিন ফ্যাকাশে মৃতদেহ পড়ে আছে ফুটপাতে। দেরি না করে ফোন করে পুলিশকে এবং ঘটনা খুলে বলে। পুলিশ এসে লাশটিকে পর্যবেক্ষণ করে, সেখান থেকে উদ্ধার হয় একটি চিরকুট।

চিরকুটটিতে লিখা আছে, 'আমাকে খোঁজার জন্য কেউ বৃথা চেষ্টা করলে তার অবস্থা ঠিক এমনই হবে। আমি জানি, আপনাদের আইন সবার জন্য সমান নয়। উচ্চবিত্ত আর ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে বিশেষ সুবিধা। তারা যদি হাজারটা অপরাধ করে তবুও তাদের কোনো শাস্তি দেয়া যাবে না। কিন্তু যদি টাকা কিংবা ক্ষমতা না থাকে তবে নিরপরাধ মানুষকেও শাস্তি দিতে পারে আপনাদের আইন।

যেদিন তারা মেয়েদের ইজ্জতে হাত দিয়েছিল সেদিন কোথায় ছিল আপনাদের আইন? যখন হায়েনার মতো মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই মানুষের মতো আকৃতির হিংস্র জানোয়ারগুলো, তখন কোথায় ছিল আপনাদের আইন? কেন অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো সেই ভুক্তভুগি মেয়েদেরকেই বারবার বিস্তারিত জানতে চেয়ে হয়রানি করেছিল পুলিশ?

এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমি নাহয় সেই জানোয়ারগুলোকে শাস্তি দিলাম, কিন্তু নিরীহ দুইজন ব্যক্তিকে কেন ব্যবহার করলাম?

তারা দুইজন এমনিতেই আত্মহত্যা করতো, আমি তাদেরকে একবার বাঁচিয়েছি আত্মহত্যার পথ থেকে। ভাবলাম, তারা তো আবার আত্মহত্যা করতে পারে, তবে আত্মহত্যার আগে না হয় একটি ভালো কাজ করে গেল।

আর এই সেই গোয়েন্দা অফিসার, যার কাছে আমি গিয়েছিলাম সেই মেয়েদের নিয়ে। কিন্তু একে তো সে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তাদের বিরুদ্ধে, উল্টো সব দোষ চাপিয়ে দিয়েছিল আমার বিরুদ্ধে। আমার প্রতিশোধ আজ পূর্ণ হলো। তবে যখনই এমন হায়েনারা ফিরে আসবে, তখনই আমি জেগে উঠবো। কারণ আপনাদের আইন তাদেরকে নায্য বিচার দিতে অক্ষম।

চিরকুটের লিখা সিরাজের পড়া হলে সেখান থেকে সরে গেল এক পথচারী। তার সরে যাওয়াটা নজর এড়ায়নি সিরাজের। কারণ সে জানে, গত তিন বছর আগে কে সেই মেয়েদেরকে নিয়ে গিয়েছিল মাহফুজুর রহমানের কাছে। শুধু যে জানে তাও না, সিরাজই সেই ব্যক্তি যে তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে কাজগুলো করতে।

তবে সিরাজ এবং অজ্ঞাত পথচারীর ঠোঁটের কোণের হালকা তৃপ্তিময় হাসিটা কারো নজরে আসে না।


#সমাপ্ত

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post