প্রতিক্ষা- মো: মিসাদ আলী || ছোটগল্প || চাঁপাই পোস্ট


মধ্যরাত, প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। ছাদে বসে সেই বৃষ্টির জলের সাথে নিজের চোখের অশ্রু মিলিয়ে দিচ্ছে নাশিদ। বুকের ভেতর রাখা চাপা যন্ত্রণাটা আজ একটু বেশিই কষ্ট দিচ্ছে তাকে। 
কাল মুনতাহার বিয়ে, কথাটা শোনার পর নিজেকে সামলে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। নাশিদের বড়ো চাচা সিরাজ আহমেদের মেয়ে মুনতাহা। মুনতাহা তার থেকে মাত্র তিন বছরের ছোটো, তার বড়ো ভাই রাশেদ নাশিদের সমবয়সী। তাই তিনজনেই বড়ো হয়েছে প্রায় একসাথেই। কখন যে তাকে নিজের সবকিছু ভাবতে শুরু করেছে বুঝতেই পারেনি সে। কী রকম রিয়্যাক্ট করবে তা ভেবে তাকে কিছু বলতেও পারেনি। কয়েকদিন আগে মুনতাহার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। অনেকবার চেষ্টার পরও কোন এক অজানা কারণে বলা হয়ে ওঠে না আর। আজ সে বাড়িতে একা, সবাই তার চাচার বাসায় গেছে। সবাই বলতে তার মা আর বাবা, কারণ সে তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তার কাজ আছে তাই বিয়ের দিন সকালে যাবে বলে থেকে যায় সে ।
আজকের প্রকৃতিটাও কেন জানি তার মনের অবস্থার সাথে মিলে গেছে। অঝর ধারায় বয়ে চলেছে তার চোখের জল, সেই সাথে তাল মিলিয়ে চলছে বৃষ্টির ধারা। হঠাৎ বাসার সামনে বাইক থামার শব্দ পেলে এগিয়ে আসে সেই দিকে। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার। বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ, আর তার পাশে মুনতাহা। দুজনেই বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। দৌড়ে নিচে নেমে আসে নাশিদ। দরজাটা খুলে এগিয়ে যায় তাদের দিকে। একদম কাছে চলে আসলে মুনতাহার চোখের জল স্পষ্ট দেখতে পায় সে। 
না, এগুলো বৃষ্টির জলের মতো না, এগুলো অশ্রুই। সে কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক এমন সময় হঠাৎ করেই জড়িয়ে ধরে মুনতাহা। -সারাজীবন কি এমনই হাদারামই থাকবে? নিজের মনের কথাগুলো বলতে পারো না?' অভিমানী কণ্ঠে কথাগুলো বলে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মুনতাহা। -সব কথা কি না বললেই নয়? কিছু কথা তো তুমি বুঝে নিতে পারো চোখের ভাষায়।' চোখদুটো বন্ধ করে অনুভব করে বলে নাশিদ। 
-চোখের ভাষা আমি বুঝেছি বলেই তো আমি এখানে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। নইলে হয়তো গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে থাকতাম এতক্ষণ। তুমি নিজেই তো চোখের ভাষা বুঝ না, আবার আমাকে বলছো। 
-আমি জানি তুমি আমায় কতটা ভালোবাসো। কিন্তু তারপরও ভয় হয়, যদি হারিয়ে ফেলি তোমায়। 
-ওসব কথা রাস্তায় যেতে যেতে বললেও চলবে। তোরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়। আমি বাসায় যাই। নইলে যদি আব্বু জানতে পারে যে তোদেরকে পালাতে আমি সাহায্য করেছি, তবে আমাকে শেষ করে ফেলবে' তাদের কথার মাঝে কথাগুলো বলে বাইক নিয়ে চলে যায় রাশেদ। 
বাইরে বৃষ্টি একেবারেই কমে এসেছে, তাদের দুজনের পালানোর সব ব্যাবস্থা সম্পন্ন। দুজনই বের হয়ে যাচ্ছে বাসা থেকে, কিন্তু কী যেন ভেবে থমকে দাঁড়ায় নাশিদ। 
-কী হলো? দাঁড়িয়ে পড়লে যে? আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলো তাড়াতাড়ি।' জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে মুনতাহা -আচ্ছা মুনতাহা, আমরা যা করছি তা কি ঠিক? 
-তো? এখানে ভুল আবার কী?' অবাক হয়ে বলে সে -আমাদের ফ্যামিলি আমাদের ওপর কত ভরসা করে, আর আমরাই কিনা সমাজের কাছে তাদেরকে ছোটো করে দিবো! এটা কি ঠিক হবে? 
-তাহলে কী চাও তুমি? তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করে আমার স্বপ্নগুলো ভেঙে ফেলি?' অশ্রুসিক্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বলতে শুরু করল' আমি যতদিন থেকে বুঝতে শিখেছি, শুধুমাত্র তোমাকেই আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে স্বপ্ন দেখে এসেছি। আজ সেই স্বপ্ন প্রায় হারাতে বসেছিলাম, তখন ভাইয়া আমাকে আমার স্বপ্ন পূরণের আশ্বাস দিয়েছে। আর তুমি বলছ আবার ভেঙ্গে ফেলতে! জেনে রেখো, আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবো না। প্রয়োজনে শেষ শক্তি অবদি চেষ্টা করে যাবো। 
-দেখ, এমন পাগলামী করতে হয় না। এটা আগে যদি আমাদের ফ্যামিলিতে জানতাম, হয়তো তারা রাজি হয়ে যেত। কিন্তু কাল তোমার বিয়ে, তারা কেউ রাজি হবে না। তুমি একবার তাদের জায়গায় নিজেকে রেখে বোঝার চেষ্টা করে দেখ। 
-যেহেতু তারা রাজি হবে না, তাহলে চলো পালিয়ে বিয়ে করি। 
-পালিয়ে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি যখনই বিয়ে করি, সবার সামনে করবো। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় মুনতাহা। চোখের অশ্রুগুলো কপল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তার। নাশিদ বাইক বের করলে সেটায় উঠে বসে সে। বাইকের গতি বাড়ায় নাশিদ। বৃষ্টি থেমে গেলেও পরিবেশটা বেশ শীতল হয়ে আছে। অপরদিকে বাইকের পেছনে বসে থাকা মুনতাহার মনে বয়ে চলেছে কাল বৈশাখী ঝড়। মিনিট ত্রিশের আগেই তারা পৌঁছে যায় মুনতাহাদের বাসায়। রাশেদকে ফোন করে দরজা খুলতে বলে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দরজা খুলে যায়। নাশিদ সামনে তাকিয়ে দেখে, দাঁড়িয়ে আছে তার বড়ো চাচা, চাচি, রাশেদ আর তার মা-বাবা। সবাইকে এভাবে দেখে কিছুটা ভয় হয় তার। তবে সবার চোখে রাগের চাইতে বিষ্ময়ের ছাপ স্পষ্ট লক্ষ্য করে সে । 
-কী ব্যাপার? তোরা ফিরে এলি যে?' অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে রাশেদ 
-কিছু বলার আগে ভেতরে এসো, কেউ দেখলে ঝামেলা হবে।' গম্ভীর মুখে বলেন সিরাজ আহমেদ। তারা ভেতরের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। বিয়ে বাড়ি আসা মেহমান সবাই অঘোরে ঘুমাচ্ছে। 
-এবার বলো, ফিরে আসলে কেন? আমাদের মুখে তো চুনকালি মাখানোর ব্যাবস্থা করেই দিয়েছ।' আবার বলে উঠলেন সিরাজ আহমেদ। নাশিদের মা-বাবা রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন। 
-আমাদের ক্ষমা করে দিয়েন চাচ্চু। আমরা বড়ো একটা ভুল করে ফেলেছি।' কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে নাশিদ ।
-ক্ষমা! কীসের ক্ষমা? তোমরা যা করেছো তার কোনো ক্ষমা হয় না। আমি কখনও ভাবতেই পারিনি যে আমাদের ছেলে-মেয়েরা এমন একটা নিচু কাজ করবে। 
-প্লিজ আব্বু, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর নাশিদের কোনো দোষ নেই, আমিই গিয়েছিলাম তার কাছে। সে তো আমাকে ফিরিয়ে দিতে এসেছে।' কাঁদতে কাঁদতে বলল মুনতাহা 
-তোমরা যা করেছো তার জন্য তোমাদের দুজনকেই শাস্তি পেতে হবে। ' 
কিছুক্ষণ থেমে কান্না জড়িত কণ্ঠে আবার বলতে থাকেন সিরাজ আহমেদ' আমাদের ক্ষমা করে দিস রে মা। আমরা তোর মত না জেনেই বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি। তোরা যা করেছিস তা ভুল কিছু না। যা তোরা বিয়ে করে নে। 
-না চাচ্চু, এটা আমরা পারবো না। আমাদের কারণে সমাজের কাছে আপনাদের মাথা নিচু হবে, আমরা তা সহ্য করতে পারব না। আমি সকাল দশটায় আসবো, এখন কিছু কাজ আছে।' বলেই কারো কথা না শুনে বাইরে বেরিয়ে গেল নাশিদ। পেছনে সবাই অনেক ডাকলেও সে ফিরে এলো না। ঘুম কারো চোখে এলো না, সবাই বসে রইল রুমের মধ্যে। 
সকালে সবাই বিয়ের উৎসবে মেতে উঠেছে, কিন্তু পাঁচ জনের মধ্যে উৎসবের কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। বেলা গড়িয়ে চলেছে ধীরে ধীরে, বধুরূপে সাজানো হয়েছে মুনতাহাকে। সিরাজ আহমদ অনেক ভেবে ফোন করলেন বরের বাবাকে। কয়েকবার ফোন বাজার পর রিসিভ করলেন তিনি। -আমিই আপনাকে ফোন করতাম, কিন্তু কী বলে ফোন করবো বুঝতে পারছিলাম না।' সিরাজ আহমেদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলতে থাকে বরের বাবা' আজকালকার ছেলে-মেয়েদের কারণে তাদের মা-বাবার মাথা হেঁট হয়ে যায়। 
আজ সকালে ঘুম থেকে জেগে সাব্বিরের রুমে এসে দেখি সাব্বির নেই। ভাবলাম বাইরে কোথাও আছে, কিন্তু সারা বাড়ি খুঁজেও কোথাও পেলাম না। অবশেষে ফোন করলাম, কিন্তু ফোন বন্ধ। তার রুমের টেবিলের উপর একটা চিরকুট পেলাম, যেটায় লিখা আছে সে নাকি কোন একটা মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। আমি বিষয়টা কীভাবে বলবো সেটাই বুঝতে পারছি না। আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ। এতটুকু বলেই ফোন কেটে দিলো, সিরাজ আহমেদকে কিছু বলতেই দিলো না। মনে মনে ভাবলেন, কেমন মানুষরে ভাই? আমি ফোন করলাম আর আমাকেই কিছু বলার সুযোগ দিলো না। যাক ভালোই হলো, কিন্তু নাশিদটা আবার আসবে কখন? এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হলো নাশিদ। বর অন্য মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে শুনে সারা বাড়িতে কোলাহল সৃষ্টি হয়ে গেল। এর মাঝে নাশিদ আর মুনতাহার বিয়েটাও নির্ভেজালে হয়ে গেল। বাসরঘরে ঢুকতেই বউয়ের কড়া ভাষায় শুনতে হলো, 
-খবরদার কাছে আসার চেষ্টা করবা না। আমাকে বিয়ে করার তো কোনো ইচ্ছেই তোমার নেই, ভাগ্য ভালো ব্যাটা বিয়ের আগে পালায়ছে। 
-ভাগ্য ভালো, তাই না? আর সারারাত ধরে আমি যে এত প্ল্যান করলাম তা কিছু না?' হাসতে হাসতে বলে নাশিদ 
-প্ল্যান! তুমি আবার কী প্ল্যান করেছো?' কিছুটা অবাক হয় সে 
-তুমি কি ভাবছো সাব্বির কারো সাথে পালিয়েছে? 
-হুম, তার আব্বু তো আব্বুকে সেটাই বলেছে। 
-আমি বাসায় ফিরে ফোন করে ডেকেছিলাম শিহাব আর সুমনকে। 
তারপর তিনজনে মিলে সাব্বিরের বাসায় গেলাম আর সেখানে একটা চিরকুট রেখে তাকে তুলে নিয়ে এলাম। তাকে এখন একটা গোডাউনের মধ্যে বন্দী করে রাখা আছে, দুইদিন পরে ছেরে দিবো।' বলেই হাসতে থাকে নাশিদ, সেই হাসির সাথে যোগ দেয় মুনতাহা। দুজনের চার ঠোঁট এক হয়ে যায়। 
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় নাশিদের। বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে, কারো অনুপস্থিতি তার হৃদয়ের মাঝে ভাঙচুর করে চলেছে। তার মনে পড়ে, গতকাল অর্থাৎ মুনতাহার বিয়ের দিন তো তার জানাজা পড়িয়েছে। বিয়ের আগের রাতে আত্মহত্যা করেছিল মুনতাহা। তার সাথে দেখা করার প্রতিক্ষায় দিন পার করছে নাশিদ। হয়তো শীঘ্রই দেখা হবে দুজনের।










1 Comments

  1. 1xbet - No 1xbet Casino | Live dealer casino online
    1xbet is a reliable septcasino.com casino 1xbet korean site that https://access777.com/ offers a great casino games from the best software providers for the regulated gambling markets. Rating: 8/10 · kadangpintar ‎Review by a Tripadvisor user · ‎Free · poormansguidetocasinogambling ‎Sports

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post